সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে দলবদ্ধ ধর্ষণের সেই ঘটনা আদালতকে জানিয়েছেন নির্যাতিত তরুণী। গতকাল রবিবার দুপুরে সিলেট মহানগর হাকিম তৃতীয় আদালতের বিচারক শারমিন খানম নিলার কাছে রাতে কী ঘটেছিল তার বর্ণনা দেন। পুলিশ ওই তরুণীকে গতকাল দুপুরে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে আদালতে নিয়ে আসে। দেড়টার দিকে আদালতে ওই রাতের ঘটনার ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা দেন। আদালত তার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন।
এদিকে গণধর্ষণের ওই ঘটনায় হওয়া মামলায় গতকাল রবিবার চার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সকালে প্রধান আসামি সাইফুর রহমান সুনামগঞ্জের ছাতক সীমান্ত এলাকা থেকে এবং চার নম্বর আসামি অর্জুন লস্করকে হবিগঞ্জের মাধবপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। রাতে হবিগঞ্জ শহরের কোরেশনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আরেক আসামি মাহাবুবুর রহমান রনিকে। একই সময় নবীগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার হন আসামি রবিউল ইসলাম।
ছাতক থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন, ছাতক খেয়াঘাটসংলগ্ন এলাকা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এসআই হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে একদল পুলিশ সাইফুরকে গ্রেপ্তার করে। দাড়ি কেটে চেহারা বদলে ফেলার চেষ্টা করেছিল সে। অপরদিকে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার মনতলা সীমান্ত এলাকা থেকে অর্জুন লস্করকে গ্রেপ্তার করে সিলেট জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। সে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনায় ছিল।
রাতে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্লা অন্য দুই আসামি রনি ও রবিউলকে গ্রেপ্তারের কথা জানান। পুলিশ সুপার বলেন, ডিবি পুলিশের একটি দল অভিযান চালিয়ে রবিউলকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে হবিগঞ্জ শহরের কোরেশনগর থেকে রাত সাড়ে আটটার দিকে রনিকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৯।
এর আগে ওই ধর্ষণের ঘটনায় ছয়জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও তিনজনকে আসামি করে শনিবার সকালে নগরীর শাহপরান থানায় মামলা করেন নির্যাতিতার স্বামী। মামলার অন্য দুই আসামি তারেক ও মাহফুজুর রহমান গতকাল রাত পর্যন্ত পলাতক ছিল। তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
ঘটনার দিন গত শুক্রবার রাত ২টার দিকে পুলিশ অভিযুক্ত সাইফুরের কক্ষ থেকে একটি পাইপগান, চারটি রামদা, একটি ছুরি ও দুটি লোহার পাইপ উদ্ধার করে। তার নামে অস্ত্র আইনে মামলা হয়েছে।
এদিকে ধর্ষণকা-ের পর সিলেটসহ সারাদেশেই নিন্দার ঝড় বইছে। সিলেটে বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি পালন করেছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোও বিবৃতি দিয়ে ধর্ষক ও তাদের লালনকারীদের শাস্তি দাবি করেছে। দায়িত্বে অবহেলার জন্য এমসি কলেজের অধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করেছে সিলেট আওয়ামী লীগ।
গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে এসএমপি কমিশনারের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে তিনি প্রতিবাদী পদযাত্রা করে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে শাহজালাল উপশহরস্থ সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে যান।
ধর্ষণে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে এসে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে পুলিশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে মেয়র ও কাউন্সিলররা বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকার প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে বখাটেপনা, ইভটিজিং ও ধর্ষণসহ সকল প্রকার অপরাধ কর্মকা- প্রতিরোধে এখন থেকে নিয়মিত সিসিক ও পুলিশ যৌথভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে। অভিযানে নেতৃত্ব দেবেন সিসিকের নির্ধারিত ম্যাজিস্ট্রেট।
মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, আধ্যাত্মিক মর্যাদার এই নগরীকে আমরা স্মার্ট পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করছি। কিন্তু এই নগরীতে একজন পর্যটক যদি এমন নিকৃষ্ট ঘটনার শিকার হন, তবে আমরা জনপ্রতিনিধি হয়ে লজ্জিত না হয়ে পারি না। তিনি আরও বলেন, এমন অপরাধে জড়িতের কোনো দল হয় না। আর যেন এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য দায়ীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন কাউন্সিলর শান্তনু দত্ত সন্তু, কাউন্সিলর রেজাউল হাসান লোদী, কাউন্সিলর তৌফিক বকস, কাউন্সিলর ইলিয়াসুর রহমান, কাউন্সিলর সৈয়দ তৌফিকুল হাদী, কাউন্সিলর আফতাব হোসেন খান, কাউন্সিলর এবিএম উজ্জলুর রহমান, কাউন্সিলর মো. আবদুর রকিব তুহিন, কাউন্সিলর মো. ছয়ফুল আমীন, কাউন্সিলর আবদুল মুমিন, কাউন্সিলর তারেক উদ্দিন তাজ, কাউন্সিলর মোস্তাক আহমদ, কাউন্সিলর এসএম শওকত আমীন তৌহিদ, কাউন্সিলর আবদুল মুহিত জাবেদ, সংরক্ষিত কাউন্সিলর শাহানারা বেগম, শাহানা বেগম শানু, মাসুদা সুলতানা, রেবেকা বেগম রেনু, কুলসুমা বেগম পপি, নাজনিন আক্তার কণা প্রমুখ।
এদিকে কলেজের ছাত্রাবাসে তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনায় ওই কলেজের অধ্যক্ষ ও ছাত্রাবাসের সুপারের পদত্যাগ দাবি করেছে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ। কলেজ বন্ধ থাকা অবস্থায়ও কী করে ছাত্ররা ছাত্রাবাসে থাকে- এ প্রশ্নও তুলেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসিরউদ্দিন স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়- করোনাকালে যেখানে সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, সেখানে সিলেট এমসি কলেজের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে যেভাবে দুবর্ৃৃত্তরা প্রবেশ করে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে, তা আমরা মেনে নিতে পারছি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাস বন্ধ থাকাকালে কীভাবে দুর্বৃত্তরা স্বামী-স্ত্রীকে ধরে নিয়ে ছাত্রাবাসে প্রবেশের সুযোগ পেল তা সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান। কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিষ্ঠানে আদৌ কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কিনা তা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা সিলেট এমসি কলেজের অদক্ষ, দায়িত্বহীন অধ্যক্ষ ও ছাত্রবাসের সুপারের পদত্যাগ দাবি করছি।
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রাইভেট কারযোগে স্বামীকে নিয়ে এমসি কলেজে বেড়াতে আসেন দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ির এক তরুণী। ক্যাম্পাস থেকে বাইরে এসে তরুণীর স্বামী একটি দোকানে যান। তখন ছাত্রলীগের ওই সাত কর্মী মিলে তরুণীকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। স্বামী ফিরে এসে বাধা দিলেও ছাত্রলীগকর্মীরা ভয় দেখিয়ে প্রাইভেট কারসহ স্বামী-স্ত্রীকে পার্শ্ববর্তী কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে যায়। সেখানে স্বামীকে বেঁধে মারধর করে গাড়িতেই তরুণীকে ধর্ষণ করে।
খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে স্বামীসহ ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। পরে তরুণীকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে প্রেরণ করে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাবেক লীগের কয়েক নেতা। তারা ও কলেজ কর্তৃপক্ষ ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে পুলিশ সময়ক্ষেপণ করায় ধর্ষকরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বলেও অভিযোগে জানা যায়।
অসমর্থিত সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে ভয় দেখিয়ে দম্পতিকে ছাত্রাবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্য একটি সূত্র বলছে, পূর্ব বিরোধের জের ধরে অভিযুক্ত ছাত্রলীগকর্মী শাহ মাহবুবুর রহমান রনি অন্যদের সঙ্গে নিয়ে তরুণীকে তুলে নিয়ে যায়। তার পর তাকে গণধর্ষণ করা হয়।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন হবিগঞ্জ প্রতিনিধি রুহুল হাসান শরীফ, মাধবপুর প্রতিনিধি অলিদ মিয়া ও ছাতক প্রতিনিধি বিজয় রায়
Leave a Reply